দেশ জুড়ে চলছে মহামারী, তা প্রায় নয় নয় করেও পেরোলো বছর খানেক।’মহামারী’- এমন একটা শব্দের সাথে এতদিন বাঙালির পরিচয় ছিল হয় থ্রিলার গল্পের বইয়ের পাতায় আর নাহলে কোনো সায়েন্স ফিকশন সিনেমাতে। সেখানে প্রতিবার ঠিক একজন সুপার হিরো এসে বাঁচিয়ে নিত পৃথিবীকে। কিন্তু আসলে যে রিল আর রিয়েল লাইফের ফারাক বিস্তর। মহামারীতে শুধু প্রানটুকু কোনো ভাবে বাঁচানো গেলেই নিস্তার নেই, বালাই আরো অনেক। যে বাঙালি তার বিগত তিন প্রজন্মেও কখনো ‘লকডাউন’ ‘কোয়ারেন্টাইন’ এই শব্দগুলো অবধি ভালো মতন শোনেনি তাদেরকেই যুঝতে হচ্ছে আজ এই সব ভারী ভারী শব্দ গুলোর সাথেই শুধু নয়; এদের তথাকথিত ‘consequences’ এর সাথেও। কার্যতই বেহাল অবস্থা দেশের অর্থনীতির। এই অবস্থায় অন্যান্য ক্ষেত্রের মতই প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে পর্যটন শিল্প এবং তার সাথে জড়িত রাজ্যের কয়েক লক্ষ্য মানুষের জীবন,ভবিষ্যৎ। যাঁদের রুটি রুজি পুরোটাই নির্ভরশীল এই পর্যটনের ওপর, তাঁরা সত্যিই জানেন না আবার কবে স্বাভাবিক হবে সবকিছু;আবার কবে ঘুরতে বেরোবে মানুষ।
আপাত ভাবে মনে হতেই পারে যে পর্যটন শিল্পে এই ধ্বসের ফলে ক্ষতির সম্মুখীন কেবল মাত্র ট্যুর গাইড, ট্রাভেল এজেন্সি আর হোটেল মালিকেরাই। কিন্তু বাস্তবের ছবিটা আরো বেশি কঠিন। আরো অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী এই মহামারীর প্রভাব।
পাহাড়ী অঞ্চলের ছোটো ছোটো গ্রাম গুলির মানুষদের একমাত্র প্রধান জীবিকাই হল পর্যটন। উষর পাহাড়ি জমিতে কৃষিকাজের অপ্রতুলতার জন্য,এবং দুর্গম অঞ্চলে অন্য কোনো কর্মসংস্থান এর সুযোগ না থাকায় তাঁদের প্রায় পুরোটাই ভরসা করতে হয় পর্যটনের ওপর। প্রত্যন্ত কোনো পাহাড়ী গ্রামের হোমস্টেই হোক বা আঞ্চলিক গাড়ির ড্রাইভার, সবারই বাৎসরিক আয়ের সিংহভাগই আসে বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে পর্যটকদের আনাগোনার ফলে। মোটামুটি শীতের শেষ থেকে বর্ষার শুরু আবার পুজোর সময় থেকে নভেম্বর -ডিসেম্বর,এই কয়েক মাসই হল এলাকা ভেদে পর্যটনের ‘সিজন’।
লকডাউনের ফলে ‘পিক সিজনে’ সমস্ত কিছু বন্ধ থাকায় উপার্জনের অভাবে সত্যিই এই মুহুর্তে একপ্রকার অসহায় ভাবেই দিন কাটাচ্ছেন এই সব মানুষেরা। দার্জিলিং এবং সিকিম সীমান্তে প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফুট উচ্চতায় হাতে গোনা কয়েকটা পরিবার নিয়ে ছবির মতন সুন্দর ছোট্ট গ্রাম সামানদেন।এখানে পৌঁছাতে হলে ট্রেক করে উঠতে হয় প্রায় ঘন্টা পাঁচেক ধরে। সবচেয়ে কাছের পাকা রাস্তায় পৌঁছতেও এখান থেকে হেঁটে যেতে হয় প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা। এখানকার ওই গুটি কতক পরিবারের একমাত্র জীবিকা হল হোমস্টে ব্যাবসা। সামানদেনের শেরপা হোমস্টের মালিক দীনেশ শেরপার কথায়,” অফবিট জায়গা বলে এমনিও এই রুটে পর্যটকের সংখ্যা হাতে গোনাই থাকে,কিন্তু তাও যে কজন বা আসেন এবছর এই মহামারীর জন্য আসতে পারেননি তাঁরাও।এদিকে শীতকালও শুরুর মুখে,আর কিছুদিনের মধ্যেই বরফ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হতে যাবে সামানদেন। তখন আবার অপেক্ষা করতে হবে সামনের বছর গরম কালের জন্য। ততদিন চলবে কীভাবে, সে উত্তর সত্যিই জানা নেই দীনেশজীর নিজেরও।
শুধুমাত্র অফবিট গ্রামই নয়, দার্জিলিং, কালিম্পং এর মতন জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলিতেও স্পষ্টতই চোখে পড়ছে লকডাউনের প্রভাব। কথা হচ্ছিল আরেক হোমস্টে মালিক দার্জিলিং এর বিজয় রাইয়ের সাথে। তিনি জানালেন লকডাউনের জন্য দার্জিলিং এ অক্টোবর অবধি বন্ধ ছিল সব কিছুই। যেহেতু দার্জিলিং এ সব জিনিসই প্রায় আসে নীচে শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে করে, তাই মাঝখানে এমন অবস্থা হয়েছিল যে খাদ্য সংকট অবধি দেখা দিয়েছিল। তিনি আরো জানালেন যে শুধুই অর্থনৈতিক সমস্যাই নয়, এই সমস্ত সমস্যার সাথে লড়তে লড়তে মহামারীর ভয়ে ঘরবন্দী হাসিখুশি পাহাড়ী মানুষগুলোর মানসিক স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়েছিল একপ্রকার। অনেকেই শিকারও হয়েছেন ডিপ্রেশন এর মতন মানসিক সমস্যার। সবকিছু আবার আগের মতন হতে শুরু না করলে সেসব ঠিক হওয়ার আশাও দেখছেন না বিজয়জী। যে দার্জিলিং এ কিছুদিন আগেও সার দিয়ে চোখে পড়ত ছোটো ছোটো খাবারের দোকান, ভরা অক্টোবরে পুজোর মরশুমে যেখানে ভীড়ে উপচে পড়ে দার্জিলিং, সেখানে পর্যটকদের মতই ভ্যানিশ সেইসব ছোটো দোকানও। একই ছবি কালিম্পং জুড়েও। পর্যটকের অভাবে হোটেল থেকে শুরু করে গাড়ি বন্ধ বেশ অনেককিছুই।খাঁ খাঁ দশা এককালে গমগম করতে থাকা রাস্তা,বাসস্ট্যান্ডের।
এদিকে সুন্দরবনের ছোট্ট একটা দ্বীপ মৌসুনি। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পর্যটকদের পছন্দের তালিকার বেশ উপরের দিকেই ছিল সে।একানকার বাসিন্দাদেরও একটা বড় অংশের জীবিকাই সমুদ্রের ধারে ক্যাম্প এবং হোটেল ব্যাবসা।শুধু লকডাউনই না, এই অবস্থায় মৌসুনিকে সইতে হয়েছে আম্ফানের মতন বিরাট সাইক্লোনের ধাক্কাও। তাই সাত মাস পর আবার করে খুললেও বরাবরের মতন বন্ধ হয়ে গিয়েছে অর্ধেকের বেশি ক্যাম্প এবং হোটেল। দীঘা, মন্দারমনি, শান্তিনিকেতনের মতন ঘরের কাছে ছুটি কাটানোর জায়গা গুলিও বন্ধ ছিল প্রায় ৬মাস। আস্তে আস্তে খুললেও ট্রেন সেভাবে না চলায় একমাত্র নিজস্ব গাড়ি ছাড়া যাওয়া যাচ্ছেনা এই জায়গাগুলিতেও। ফলে হোটেল এবং রিসর্টগুলি দীর্ঘকাল বন্ধ থাকায় ক্ষতির মুখে পড়ে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে কয়েক হাজার কর্মচারীকে।
শহরের ট্রাভেল এজেন্সি গুলিও রোজগার হীন টানা প্রায় ছ’সাত মাস। যে সব এজেন্সি মানুষকে গাড়ি করে ঘুরতে নিয়ে যেত তারাও এখন সেই সমস্ত ট্যুর বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনে।আবার যে সব এজেন্সির ভরসা ছিল ট্রেন, ট্রেনের অপ্রতুলতার জন্য সেগুলিও থমকে গেছে একেবারেই।এই অবস্থায় একান্ত ভ্রমন প্রেমী মানুষজন ছাড়া আর কেউই তেমন ভরসা পাচ্ছেননা বেড়াতে যেতে। শুধু মহামারীর ভয়ই নয়। লকডাউনের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত পুরোদেশের অর্থনীতিই।তাই টাকা পয়সার টানাটানিতে মানুষের এখন ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের হাতেই। সিকিমের মতন জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলির অর্ধেকের বেশি অংশই এখনো বন্ধ পর্যটকদের জন্য। যেটুকু বা খুলেছে তাতেও ট্যাক্স বাসিয়ে সিকিম ভ্রমনের খরচ বেড়েছে প্রায় ৩৫%।
সব তো হল,কিন্তু বেরোলেও কবে?…মহামারীর পরে ঘুরতে যাওয়া,ঠিক কতটা সেফ হবে….কী কী সেফটি মেজরস থাকবে প্রায়োরিটি লিস্টে ওপর দিকে? হাজার একটা প্রশ্ন! হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে সবারই মাথায়। তবে উপায়? সমস্যাও যখন নতুন,তখন আমাদেরকেও নতুন রকম ভাবে ভাবতে শিখতে হবে! নতুন সমস্যার চাই নতুন সমাধান। আমরা নিশ্চয়ই আবার বেরোবো,কিন্তু অবশ্যই কিছু জিনিস মাথায় রেখে। এই সিচুয়েশনে দাঁড়িয়ে একটা বিশাল চিন্তার কারণ হল সামাজিক দূরত্ব বিধি বজায় রাখা এবং যথা সম্ভব ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে চলা। তাই আমরা এবার থেকে এমন সব জায়গাই বাছব যেখানে মানুষ কম,যেখানে ভীড় কম। দীঘা কিংবা পুরীর জায়গায় লিস্টে থাকতেই পারে বক্সা-জয়ন্তী কিংবা সান্দাকফু, ফালুট, রামপুরিয়া, দারাগাঁও কিংবা সমুদ্রে যদি যেতেই হয় দীঘার জায়গায় বাছুন উদয়পুর, তাজপুরকে।
দার্জিলিং এর বদলে যাওয়াই যায় দাওয়াইপানি, চটকপুর কিংবা রামধুরা। এখনকার প্রায়োরিটি লিস্টে সিরিন,সিনিক,এক্সটিক এই শব্দগুলোর বদলে বরং থাকুক সিকিওরড,আইসোলেটেড,অফবিট এই শব্দ গুলো! আমরা ট্রাভেল ছাড়া সত্যিই থাকতে পারবনা,শুধু আমরাই কেন, আমাদের মতই কয়েক লক্ষ্য মানুষের জীবন এবং ভবিষ্যৎও জড়িয়ে রয়েছে এই শিল্পের সাথে। এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সরকারের তরফ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনাও নেই পর্যটনের সাথে যুক্ত লক্ষাধিক মানুষের। কিন্তু তবুও এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে সাধ আর বাধ্যতা এই দুটোকে গুলিয়ে ফেললে হবেনা যে! এমন জায়গা বাছুন ঘোরার জন্য যেখানে যেতে হলে তুলনামূলক ভাবে কম সময় থাকতে হয় ট্রেনে বা গাড়িতে। এখন নর্থ কিংবা সাউথ ইন্ডিয়া ট্রিপের বদলে বরং প্রাধান্য পাক ডুয়ার্স-কালিম্পং-অফবিট দার্জিলিং। গাড়ি করে সাইট সিয়িং এর বদলে যাওয়াই যায় কোনো ট্রেকে।নির্জন প্রকৃতির মাঝে।
ব্যাগে জলের বোতলের মতন সর্বক্ষণের সঙ্গী হোক স্যানিটাইজার এবং ডিসইনফেক্টেন্ট স্প্রে।মুখে লিপস্টিক আর মেক আপের সাথেই সবসময় থাকুক মাস্ক। জিন্দেগী তো একটাই বাবুমশাই… ডর ডরকে বাঁচার থেকে নাহয় একটু নতুন ভাবেই আবার বাঁচতে শিখলাম আমরা… আগামী কয়েকটা বছরের জন্য। এভাবেই নাহয় একটু একটু করে হলেও আবার আগের ছন্দে ফিরুক পৃথিবী।
কী বলেন?