পুরুষের ছদ্মবেশে এ এক নারীর যুদ্ধ জয়ের গল্প। পুরুষের ছদ্মবেশে সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এক নারীকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করার ঘোষণা দেয়।ষোড়শ শতাব্দীর আমেরিকায় কোনো নারীর সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার নিয়ম ছিল না।ষোল শতকের শেষভাগে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের এই ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। চার্চের ভাষ্যমতে, সেই নারী অসামাজিক ও অনারীসুলভ আচরণ প্রদর্শন করেছিলেন। যদিও সেই অভিযুক্ত নারী শুধুমাত্র পুরুষের পোশাক পরিধান করে সেনাবাহিনীতে অংশ নিতে চেয়েছিলেন। তাই সে সময় সেনাবাহিনীতে নারী হিসেবে অংশগ্রহণ করা আসলে একইসাথে অসম্ভব ও অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে নারীরা আমেরিকার রেভল্যুশনারি যুদ্ধে (১৭৭৫-৮৩) সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও সেবিকা ও রাঁধুনি হিসেবে বিভিন্ন সেনাক্যাম্পে অবস্থান করতেন। তাছাড়া কেউ কেউ সহযোদ্ধা হিসেবে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছেন। তবে এর মধ্যে কিছু নারী শুধু সহযোদ্ধা নয়, যোদ্ধা হতে চেয়ে সবার অলক্ষ্যে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে পুরুষের ছদ্মবেশে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম ডেবোরা স্যাম্পসন, যার সাহস ও বুদ্ধিমত্তা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছিল। ডেবোরা স্যাম্পসন ১৭৬০ সালের ১৭ ডিসেম্বর, ম্যাসাচুসেটসের ছোট্ট শহর প্লিম্পটনে জন্মগ্রহণ করেন।
আমেরিকার রেভল্যুশনারি যুদ্ধ যখন শেষের দিকে ছিল, তখন ডেবোরা স্যাম্পসন হঠাৎই যুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।এজন্য তিনি প্রথমে পুরুষের ব্যবহার উপযোগী কিছু কাপড় কেনেন। সে সময় ডেবোরার বয়স ছিল ২২ বছর, আর উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির মতো। এ উচ্চতা সেসময়ের যেকোনো নারী অপেক্ষা যথেষ্ট বেশি ছিল তো বটেই, এমনকি তার কিছু সমসাময়িক পুরুষ যোদ্ধার থেকেও বেশি ছিল। তবে এই প্রথম চেষ্টায় ব্যর্থ হলেও তিনি আশা ছাড়লেন না। এরপর তিনি মিডলবরো থেকে হাঁটতে হাঁটতে বোস্টন শহরের কাছে পৌঁছান। সেখানে তিনি রবার্ট শ্রুটলিফ নাম ধারণ করেন এবং ম্যাসাচুসেটসের চতুর্থ পদাতিক বাহিনীতে যোগদান করেন। এরপর প্রাইভেট শ্রুটলিফ আরো ৫০ জন নতুন নিযুক্ত পদাতিক বাহিনীর সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধে যোগদান করার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করতে শুরু করেন।এর মধ্যেই আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশনের জন্য রবার্ট শ্রুটলিফ ও তার দলকে নির্বাচিত করা হয়। সে মিশনে তার দল বেশি ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আশানুরূপ ফলাফল লাভ করে এবং বিপজ্জনক সে মিশনে তারা ১৫ জন ব্রিটিশ সৈন্য আটক করতে সক্ষম হন।
৩রা জুলাই, ১৭৮২ তারিখে, টেরিটাউন শহরের বাইরে ব্রিটিশদের সাথে রবার্ট শ্রুটলিফের দলের সরাসরি সংঘর্ষ বাঁধে। ঘোরতর ভাবে জখম হন তিনি। চিকিৎসাকেন্দ্রে ডাক্তারের কাছে পরিচয় ফাঁস হয়ে যেতে পারে, এ ভয়ে তিনি তাদের কাছে মিনতি করেন, তারা যেন তাকে যুদ্ধক্ষেত্রেই রেখে যায়। কিন্তু তার অপারগ সহযোদ্ধারা তাকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যান।
চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়ার পর দায়িত্বরত ডাক্তার তার কপালের ক্ষতের চিকিৎসা করতে পারলেও উরুতে বিদ্ধ মাস্কেট বল বের করতে পারেননি। তার আগেই রবার্ট শ্রুটলিফ সেখান থেকে পালিয়ে যান। চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে বের হওয়ার পর তিনি নিজেই ছোট ছুরি দিয়ে উরু থেকে একটি মাস্কেট বল বের করতে সমর্থ হন। কিন্তু অপর বলটি উরুর বেশি গভীরে থাকায় সেটি আর তার পক্ষে বের করা সম্ভব হয় না। ফলে তিনি পরবর্তী সময়ে একপ্রকার পঙ্গু হয়ে যান এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ১৭৮৩ সালের জুন মাসে, আমেরিকান সৈন্যদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানোর জন্য রবার্ট শ্রুটলিফের ইউনিটকে ফিলাডেলফিয়ায় প্রেরণ করা হয়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি, তাই জেনারেলকে চিঠিতে লেখেন “পুনরায় দলে যোগদান করা, কামানের গোলাবর্ষণ মোকাবেলা করার চেয়েও কঠিন।” এরপর ২৫শে অক্টোবর, ১৭৮৩ তারিখে, জেনারেল তাকে কোনোরূপ শাস্তি না দিয়ে সসম্মানে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেন। এভাবেই একপ্রকার বাধ্য হয়েই ডেবোরা তার ছদ্মনাম ও পোশাক ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
সারা জীবন স্রোতের বিপরীতে চলা এই নারী শেষপর্যন্ত হার মানেন দারিদ্র্যের কাছে। ৬৬ বছর বয়সে পীতজ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাভাবে পরিবার তার জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনি। এমনকি মৃত্যুর পর তার কবরে হেডস্টোন দেওয়ার মতো অর্থও তাদের ছিল না। এ কারণেই তার কবর দীর্ঘদিন অযত্নে, অচিহ্নিত অবস্থায় লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার কবর চিহ্নিত করা হয় এবং তার কবরে উপযুক্ত সম্মানসূচক হেডস্টোন বসানো হয়।