‘রবিদিনে’ মাতৃস্মরণ, কেমন ছিলেন ‘রবি ঠাকুরের মা’ ? । এম ভারত নিউজ

user
0 0
Read Time:8 Minute, 4 Second

আজ রবীন্দ্রনাথ জয়ন্তী। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবসও। আজ শুধু কবিগুরুর নয়, ১৬০ বছর আগে যাঁর দৌলতে কবিগুরু দেখেছিলেন পৃথিবীর আলো, আজ তাঁর দিনও বটে। এমন এক দিনে দাঁড়িয়ে তাই রবি-মাতাকে বাদ দিয়ে শুধু রবি স্মরণ বড্ড অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। অতি অল্প বয়সেই মাতৃহারা হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, তাই বোধহয় তাঁর জীবনস্মৃতির ছত্রে ছত্রে অতি অল্পই লেগে রয়েছেন মা সারদা দেবী। মা কে নিয়ে কী বলেছেন রবীন্দ্রনাথ? ছোট্ট রবিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর করে তোলার পিছনে মায়ের হাতই বা কতখানি? আজ সেই নিয়েই কথা হোক বরং…

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সারদা সুন্দরী দেবীর পনেরোটি সন্তানের মধ্যে চৌদ্দতম। কনিষ্ঠ সন্তান ‘বুধেন্দ্র নাথ’ খুব ছোট বয়য়ে মারা যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন সংসারের একেবারে ছোট্ট। বাড়ির অতি আদুরে হলেও মাকে খুব একটা কাছে পাননি রবি। মাত্র ১৩ বছর ১০ মাস বয়সে মাতৃহারা হন তিনি। তাঁর স্মৃতিতে মায়ের উপস্থিতি খুব একটা ছিল না। মায়ের মৃত্যুর পরও মাকে নিয়ে কোনো কবিতা লেখেননি তিনি। মা তাঁকে কতখানি স্নেহ করতেন, আদর করতেন, সেসব স্মৃতির প্রতিফলন কবি রচনায় খুঁজে পাওয়া বড়ই দুষ্কর । অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ঘরোয়া’-তে রবীন্দ্রনাথের মাতৃস্মৃতি উদ্ধৃত করেছেন কবির জবানিতে, ‘মাকে আমরা পাইনি কখনো, তিনি থাকতেন তার ঘরে তক্তপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতেন যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর। তাইতো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না।’

সারদা সুন্দরী দেবী সন্তানদের প্রতি মনোযোগ দিতে পারতেন না, সেকথা ঠাকুরবাড়ির একাধিক সদস্যের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়। আসলে , সন্তানদের ব্যাপারে সারদা দেবীর এই উদাসীন্য তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত ছিল না, তা ছিল বনেদি বাড়ির প্রতিষ্ঠিত প্রথা। তবে কনিষ্ঠ পুত্রটির সঙ্গে তাঁর মায়ের একটু ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধই ছিল। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, মায়ের ঘরে রবীন্দ্রনাথ শুতেন আলাদা বিছানায়। মা কোনো দিন গল্প শুনিয়ে বা ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে তাঁকে ঘুম পাড়াতেন কি না, এমন তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। যদিও মায়ের স্বাভাবিক সস্নেহ প্রশ্রয় থেকে বঞ্চিত হননি রবীন্দ্রনাথ। যাত্রাপালা দেখার ইচ্ছে নিয়ে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়া রবীন্দ্রনাথকে ঠিক সময়ে জাগিয়ে দিয়েছেন মা। মাস্টার এসেছেন পড়াতে, পড়া ফাঁকি দিতে চেয়ে বানিয়ে মাকে বলতেন পেট কামড়ানির কথা। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘শুনে মা মনে মনে হাসতেন, একটুও ভাবনা করতেন বলে মনে হয়নি। তবু চাকরকে ডেকে বলে দিতেন, আচ্ছা যা মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়াতে হবে না।’

ঠাকুরবাড়ির সব ছেলেকেই ছোট বেলায় পালোয়ানের কাছে কুস্তি শিখতে হতো। এতে গায়ে বেশ মাটি মাখামাখি হতো। কবি লিখেছেন, ‘সকাল বেলায় রোজ এত করে মাটি ঘেঁটে আসা ভালো লাগত না মায়ের, তার ভয় হতো ছেলের গায়ের রং মেটে হয়ে যায় পাছে। তার ফল হয়েছিল, ছুটির দিনে তিনি লেগে যেতেন শোধন করতে। শোধনক্রিয়ার সামগ্রী হিসেবে থাকত বাদাম-বাটা, দুধের সর, কমলালেবুর খোসা, আরো কত কী…।’ মায়ের ওইটুকু হাতের স্পর্শই তো পেতেই রবি! অথচ মা চলে গেলেন হাতের আঙুলের চোটেই।

মায়ের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ গভীর শোকে আচ্ছন্ন হলেও চিরস্থায়ী হয়নি সে শোক। মাকে স্মরণ করে কবি লিখেছেন, ‘…বড়ো হইলে যখন বসন্ত প্রভাতে একমুঠা অনতিস্ফুট মোটা মোটা বেলফুল চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া খ্যাপার মতো বেড়াইতাম। তখন সেই কোমল চিক্কণ কুঁড়িগুলি ললাটের ওপর বুলাইয়া প্রতিদিন আমার মায়ের শুভ্র আঙুলগুলি মনে পড়িত। আমি স্পষ্টই দেখিতে পাইতাম যে স্পর্শ সেই সুন্দর আঙুলের আগায় ছিল, সেই স্পর্শই প্রতিদিন এই বেলফুলগুলির মধ্যে নির্মল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে।’

ছেলের কলমে খুব বেশি উল্লেখ না থাকলেও, যা আছে তার থেকেই ফুটে ওঠে মা-ছেলের সম্পর্কের ছবি৷ মা মারা যাওয়ার বেশ পরে রবীন্দ্রনাথ মাকে নিয়ে তাঁর দেখা একটি স্বপ্নের কথা বলেছিলেন তাঁর ‘শান্তিনিকেতন’ ভাষমালায়৷ কবি বলেন , ‘আমার একটি স্বপ্নের কথা বলি৷ আমি নিতান্ত বালককালে মাতৃহীন৷ আমার বড়ো বয়সের জীবনে মার অধিষ্ঠান ছিল না৷ কাল রাত্রে আমি স্বপ্ন দেখলুম, আমি যেন বাল্যকালেই রয়ে গেছি৷ গঙ্গার ধারের বাগানবাড়িতে মা একটি ঘরে বসে রয়েছেন৷ মা আছেন তো আছেন- তাঁর আবির্ভাব তো সকল সময়ে চেতনাকে অধিকার করে থাকে না৷ আমিও মাতার প্রতি মন না দিয়ে তাঁর ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেলুম৷ বারান্দায় গিয়ে এক মুহূর্তে আমার হঠাত্‍ কী হল জানি নে- আমার মনে এই কথাটা জেগে উঠল যে, মা আছেন৷ তখনই তাঁর ঘরে গিয়ে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে তাঁকে প্রণাম করলুম৷ তিনি আমার হাত ধরে আমাকে বললেন, ‘তুমি এসেছ!’ এইখানেই স্বপ্নটা ভেঙে গেল৷’

আসলে মা-ছেলের এ এক আশ্চর্য সম্পর্ক৷ মাকে তো সত্যিই সে ভাবে কোনোদিনই পায়নি জোড়াসাঁকোর সেই ছোট্ট ছেলেটা৷ মা-ও সে ভাবে পাননি ছেলেকে, চাইলেই জাপটে ধরতে পারেননি বুকে৷ তবুও সারা জীবন সাহিত্যের আঙিনায় কত রকম মায়ের ছবিই তৈরি করে গেলেন রবীন্দ্রনাথ৷ সৃষ্টি করলেন জগজ্জননী,বিশ্বমাতা রূপী অজস্র মাকে। মাতৃরূপের এই বহুবিধ সৃজন কি মাকে আরও একটু কাছে পাওয়ারই আকুতি ছিলনা রবীন্দ্রনাথের? মাতৃহারা শোক কি তাড়িয়ে বেড়াইনি তাঁকে? আজ কেই বা বলতে পারে সেকথা।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Leave a Reply

Next Post

করোনা রুখতে তৎপর বাঁকুড়া পুলিশ । এম ভারত নিউজ

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঁকুড়া: করোনা সুনামিতে টলমল গোটা রাজ্য। এই পরিস্থিতিতে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে এবং করোনার শৃঙ্খলকে ভাঙতে গোটা রাজ্য জুড়ে আংশিক লকডাউন ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার ।এবার সেই লকডাউনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পথে নামল বাঁকুড়া জেলা পুলিশ। রবিবার বাঁকুড়ার চকবাজার, লালবাজার সহ বিভিন্ন বাজারগুলিতে কেমন ভীড় রয়েছে এবং মানুষ […]

You May Like

Subscribe US Now

error: Content Protected