আজ ১২ই মে, আজ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জন্মদিন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সঙ্গে বড়দের যত না সখ্য তার চেয়েও ঢের বেশি সখ্যতা শিশুদের। তাঁর দৌলতেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঙালি শিশুরা বড় হয়ে উঠছে টুনটুনির বইয়ের পাতা উলটে। আর গুপি গাইন বাঘা বাইন ছাড়া যে বাঙালিত্বই অসম্পূর্ণ মশাই। ও হ্যাঁ, যে গল্পের ওপর ভিত্তি করে সত্যজিৎ রায়ের সেই অমর সিনেমা… সেই গল্পের সৃষ্টিকর্তা আর কেউ নন, স্বয়ং সত্যজিতেরই দাদু, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
সেই এক বড়ই নাক উঁচু বেড়াল মজন্তালি সরকার থেকে শুরু করে, বাঘকে ঘোল খাইয়ে ছাড়া নরহরি দাস, কিংবা টুনটুনির বইয়ের রাজার মোহর নিয়ে পালানো ছোট্ট টুনি…প্রত্যেকেরই জন্ম তাঁরই কলমের জাদু স্পর্শে। বাংলা শিশু সাহিত্যের এক স্তম্ভ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা,যে শুধু শিশুসাহিত্যই নয়, বাংলা ছাপাখানার ইতিহাসেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলার ছাপাখানাত আধুনিকীকরণের বিভিন্ন উপায় আবিস্কারে এবং ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানির প্রতিষ্ঠায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূমিকা অগাধ । নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে উনিশ শতকে মুদ্রণশিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়ে ছাপাখানাকে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি । তিনি ছিলেন একাধারে শিশুসাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রকর, আলোকচিত্রী, প্রকাশক এবং মুদ্রক।হাফটোন ছবির পথিকৃৎ বলা হয় তাঁকে। ১৮৮৫ সালে বিদেশ থেকে আধুনিক উন্নত মুদ্রণযন্ত্র এনে কলকাতার শিবনারায়ণ দাস লেনে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন উপেন্দ্রকিশোর । ১৮৯৫ সালে এই ছাপাখানাটির নামকরণ হয় ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ । ছাপার ব্লকের ক্ষেত্রে হাফটোন ব্লকের ব্যবহার তাঁরই কৃতিত্ব । তাঁর আঁকা ছবি হাফটোনে ছাপা হয় তাঁর ‘সেকালের কথা’ গ্রন্থে । তাঁর তৈরি ব্লক থেকে ‘প্রদীপ’, ‘মুকুল’, ‘সখা ও সাথী’ প্রভৃতি পত্রিকায় ভারতীয় মনীষীদের ছবি ছাপা শুরু হয় পুরো পাতা জুড়ে ।
বাঙালিদের মধ্যে উপেন্দ্রকিশোরই প্রথম তৈরি করেন একটিমাত্র আয়তাকার ৬০ ডিগ্রি স্ক্রীন ও কয়েকটি ডায়াফ্রামের সাহায্যে থ্রি কালার হাফটোন ছবির নেগেটিভ । যান্ত্রিকভাবে স্ক্রীন দূরত্ব নির্ণয় করার জন্য ‘স্ক্রিন অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন্ডিকেটর’ নামে একটি যন্ত্রও আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। এই যন্ত্রের সাহায্যেই অতি কম খরচে নেগেটিভ তৈরি করতে পারেন ফটোগ্রাফাররা।
১৯১০ সালে ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘টুনটুনির বই’।এই বইটির রঙিন মলাট এবং ভিতরের অসংখ্য রঙিন ছবি ছিল তাঁরই হাফটোন ব্লকের কৃতিত্ব।
১৩২০ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ অর্থাৎ ১৯১৩ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় বত্রিশ পৃষ্ঠাসংখ্যার কিশোরদের জন্য মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি সন্দেশকে। সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়,লীলা মজুমদার সকলেই কোনো না কোনো সময় যুক্ত থেকেছেন সন্দেশের সাথে। সন্দেশের মত ‘অতি সুস্বাদু’ কিশোর পাঠ্য পত্রিকা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সত্যিই বিরল।
আজ থেকে ১৫৮ বছর আগে আজকের দিনেই জন্ম নিয়েছিলেন এই ক্ষণজন্মা বিরল প্রতিভার অধিকারী মানুষটি। আজও বাঙালির শৈশব জুড়ে অজেয় রাজত্ব তাঁর। আজও শিশুরা স্বপ্ন বোনে টুনটুনির বইয়ের পাতায় পাতায়। আজও ভূতের রাজার বরের আশায় দিন কাটে বাঙালির। ১৫৮টা বছর পেরিয়েও সমান প্রাসঙ্গিক তিনি এই একবিংশ শতকের কংক্রিটে মোড়া সভ্যতার যুগেও। চির নবীনের দূত তিনি।বাঙালির অন্তত এক কল্পলোকের দিশারি।