
বিশাল এক নক্ষত্রের অবসান । অবশেষে থামল যুদ্ধ । আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন নায়ক-অভিনেতা, বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম নক্ষত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক সত্যজিত রায়ের হাত ধরে সৌমিত্রবাবুই প্রথম বাংলা সিনেমা কে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন । তাঁর হাত ধরেই মানুষ আজ ‘অপু’কে চিনেছে, অনুভব করেছে । অভিনয় জগতে আসার আগে থেকেই মঞ্চে নাটক করা । এমনকি এই অতিমারি পরিস্থিতির আগেও দাপিয়ে মঞ্চে অভিনয় করেছেন, নাট্য পরিচালনা করেছেন । বহু নাটক লিখেছেন, সু-লেখক, কবি, অসাধারণ আবৃত্তিকার ছিলেন । ১৪ টি কবিতার বই লিখেছেন সৌমিত্রবাবু । পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন, দাদা সাহেব ফালকে পুরষ্কার পেয়েছেন । এহাড়াও ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছেন এই বিরাট অভিনেতা । সিনেমা প্রেমী মানুষকে আমৃত্যু ভালো ছবি উপহার দিয়ে গেছেন । তাঁর দান চলচ্চিত্র জগত কোনদিন ভুলবেনা ।

প্রায় ৪০ দিনের যুদ্ধ শেষ হল আজ । শুক্রবার দুপুর থেকেই তাঁর অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করেছিল, সংকট বাড়তে থাকে শনিবার সকাল থেকে । চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিলেননা তিনি । ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে । শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই কমে গিয়েছিল তাঁর । সম্পূর্ণ অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে ১০০% ফেডারেশন সাপোর্টে রেখে দেওয়া হয়েছিল অভিনেতাকে । শনিবার রাতেই গভীর কোমায় চলে গিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । মাল্টি অর্গান ফেলিওর হওয়ার পর মস্তিষ্ক কাজ করা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিল তাঁর । শরীরের বেশিরভাগ অং-প্রত্যঙ্গই করছিলনা । আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন চিকিৎসকরা । তাঁরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, পরিস্থিতি একেবারে হাতের বাইরে । এবার কোন মিরাকল বা অলৌকিক কান্ডই বাঁচাতে পারে ফেলুদাকে । কিন্তু এবার সব শেষ ।

গত ৬ অক্টোবর করোনা সংক্রমণ নিয়ে বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সৌমিত্রবাবু । ১৪ই অক্টোবর তাঁর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসলেও কো-মর্বিডিটির কারণে হাসপাতালেই রাখা হয়েছিল তাঁকে । এরপর চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, তিনি আসতে আসতে ভালো হয়ে উঠছেন, গান শুনছেন, আর কিছু দিনের মধ্যে হাঁটতেও পারবেন । তারপর ২৫ অক্টোবর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান চিকিৎসক অরিন্দম কর জানিয়েছিলেন, ভালো নেই সৌমিত্রবাবু, তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে । অক্টোবরের শেষ থেকেই তাঁর কিডনির পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। ডায়ালিসিস করা হয় । এরপর প্রথম প্লাজমাফেরেসিস করানো হয় । তারপর স্থিতিশীলই ছিলেন তিনি । কিন্তু, আচমকা তাঁর অবস্থা বেশ অস্থির হয়ে পড়ে। ফের জ্বরও আসে অভিনেতার। যদিও চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, বার বার রক্ত দেওয়ার জন্যেই অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি প্রতিক্রিয়ায় এই জ্বর এসেছে।

চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, অভিনেতার চেতনাস্তর পাঁচে নেমে গিয়েছে। সাধারণত এই চেতনা স্তর তিন পর্যন্ত নেমে গেলেই চিকিৎসকরা ব্রেন ডেথ হিসেবে মেনে নেন। বার বার মেডিক্যাল বোর্ডের আলোচনা বসে সৌমিত্রবাবুর চিকিৎসা পদ্ধতি এবং শারীরিক অবস্থা নিয়ে । তিন খানা ডায়ালিসিসও করানো হয় । মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরলেও অবচেতন অবস্থাতেই থাকছিলেন বেশিরভাগ সময়ে যদিও চিকিৎসকরা সেটিকে করোনা এনসেফেলোপ্যাথি বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন । সেকেন্ডারি সংক্রমণ ধরার পরে একাধিক স্টেরয়েড, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিফাংগাল দেওয়ার পরেও শরীরে রক্তপাত শুরু হয়, কমে যায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা । বহু ইউনিট রক্ত এবং প্লেটলেটও দেওয়া হয় । এরপর গত শুক্রবার থেকেই তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয় । শনিবার জানানো হয়, একেবারে কমে যায় অক্সিজেনের মাত্রা । গভীর কোমায় চলে যান তিনি । তারপর মিরাকলের আশাও ছেড়ে দেন চিকিৎসকরা । অবশেষে শনিবার রাত্রে আমাদের ছেড়ে চলে যান বর্ষীয়ান অভিনেতা, চিরকালের নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।