![](https://mbharat.in/wp-content/uploads/2021/05/1599670712-5941.jpg)
আজ মে দিবস। বিশ্বজুড়ে আজকের দিনটা পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী দিবস হিসেবে। মে দিবস দুনিয়ার সব শ্রমিকদের এক হওয়ার দিন। আন্তর্জাতিক সংগ্রাম আর সৌভ্রাতৃত্বের দিন। পুঁজিবাদী প্রভুর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একই পতাকার নীচে হাতে হাত রেখে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিন। মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের কাছে জাগরণের গান, সংগ্রামের ঐক্য ও গভীর প্রেরণা।
সভ্যতার শুরু থেকেই শুরু হয়েছিল কাজের ভিত্তিতে বিভাজন। সেই বৈদিক যুগের বর্ণাশ্রমে ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শুদ্র থেকে মধ্যযুগের ভূস্বামী প্রথা। কিছু সুবিধাবাদী মানুষ চিরকালই এটা বুঝেছিলেন যে নিজে কোনো কাজ না করেই কেবল খানিক বুদ্ধি খাটিয়ে দিব্যি কাজ করিয়ে নেওয়া যায় অন্যদের দিয়ে। তারপর সেই মানুষদের শ্রমের ওপরে পায়ে পা তুলে বসে দিব্যি সুখে কাটানো যায় জীবন। এই ‘শ্রমিক ও মালিক’ এর ধারণা থেকেই পরবর্তী কালে বিশেষত প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় গড়ে ওঠে দাসপ্রথা।
১৭৬০ সালে শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই ক্রমশ বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলিতে গড়ে উঠল কারখানা।সেই সমস্ত কারখানায় রুটিরুজির টানে যোগ দিলেন অজস্র শ্রমিক । নির্দিষ্ট কোনো শ্রমদিবস বা পারিশ্রমিক ছিলনা এই শ্রমিকদের। তাঁদের কাজ করতে হত মালিকের মর্জি ও প্রয়োজন মত। রোজকার পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক ছিল অতি নগণ্য।
![](https://mbharat.in/wp-content/uploads/2021/05/WhatsApp-Image-2021-05-01-at-15.31.24-1.jpeg)
অবশেষে উনিশ শতকের শেষের দিকে ক্রমাগত শোষিত, নিপীড়িত,বঞ্চিত হতে হতে যখন সহ্যেরও সীমা পেরোলো তখন প্রাণের দায়ে একত্রিত হতে থাকলেই এই শ্রমজীবী মানুষেরা । দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দানা বেঁধে ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন। আমেরিকায় শ্রমিকদের মধ্যে গড়ে উঠল সমাজবাদী, বামপন্থী, ট্রেড ইউনিয়ন, ক্লাব ইত্যাদি।
উত্তর গোলার্ধে মে মাসের প্রথম দিনটি উদ্যাপিত হত ‘বসন্ত আবাহন দিবস’ উপলক্ষে। এই বসন্ত আবাহন উৎসব ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন তীব্র শীতের অবসানে একটু উষ্ণতার উৎসব। বিশেষত, কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষদের কাছে বসন্তের আগমন ছিল ঈশ্বরের আগমনের মতো। নিতান্ত কুটিরে বসবাস করা শ্রমিকদের কাছে এ ছিল এক পরম পাওয়া। দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মের অবসানে শীতের আবাহন হিসেবে পালিত হত ‘মে দিবস’ ।
কিন্তু এহেন সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে পালিত একটি দিন মে দিবস, একটি রাজনৈতিক সংগ্রামে পরিণত হল, যেদিন ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রমিকেরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে মিছিল করে জমায়েত হলেন আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কোয়ারে। তাঁদের দাবী ছিল শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম ও বাকি আট ঘণ্টা খেলাধুলোর সুযোগ দিতে হবে। এই দাবি স্বাভাবিক ভাবেই পুঁজিপতিদের আঘাত করল। যাঁরা এতকাল শ্রমিকদের সবরকমের চাওয়া-পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে এসেছিলেন তাঁরা যে এহেন দাবী মেনে নেবেন না সেটাই ছিল স্বাভাবিক। ফলস্বরূপ ওই নিরীহ মিছিলের উপর নেমে এলো বর্বরোচিত আক্রমণ।পুঁজিপতি শ্রেণী স্থির করে যেভাবেই হোক দমন করতেই হবে শ্রমিক আন্দোলনের নেতাদের, যাতে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে গণশ্রম আন্দোলন।
![](https://mbharat.in/wp-content/uploads/2021/05/WhatsApp-Image-2021-05-01-at-15.31.24.jpeg)
এর প্রতিবাদে ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে শুরু হওয়া শ্রমিক ধর্মঘটে সামিল হন সমস্ত শ্রমজীবি মানুষ । এই জমায়েতে পুলিশ গুলি চালায় নিরস্ত্র মানুষের উপরে। পুলিশের গুলিতে মারা যান শ্রমিকদের কয়েক জন । বহু শ্রমিক আহত হন, পরের বছর ফাঁসি দেওয়া হয় শিকাগোর এক শ্রমিক নেতার। ১৮৯০ সালের ১লা মে ফের আমেরিকায় দেশব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘট আহূত হয়। সেই থেকে প্রায় পৃথিবী ব্যাপী ‘মে দিবস’কে শ্রমদিবস হিসেবে পালনের শুরু। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ‘মে দিবস’ পালিত হয় শ্রম দিবস হিসেবে । ভারতবর্ষে চেন্নাই শহরের মেরিনা বিচে ১৯২৩ সালে প্রথম পালন করা হয় ‘মে দিবস’।
শ্রেণিহীন সমাজের কথা আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে ভাব আন্দোলনের মাধ্যমে সাম্যবাদের প্রচার করে গিয়েছেন শ্রীচৈতন্য দেব। ভাব আন্দোলনের পুরোধা স্বামী বিবেকানন্দ আজীবন কাজ করেছেন শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ সকল প্রকার ভেদাভেদ দূর করার জন্য।
কিন্তু সত্যিই কি সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে ধরিত্রীর বুকে?সত্যিই কি আজ হাসি ফুটেছে শ্রমজীবী মানুষের বুকে? যদিও প্রতিনিয়ত উঠে আসা টুকরো টুকরো ছবিগুলিতে ভেসে আসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত পৃথিবীরই ছবি, তবুও একবুক আশা নিয়ে আজও সেই সুদিনের স্বপ্নে দিন গোনা।